বাংলাদেশের চোখ ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনাল শিরোপায়


২০১১ বিশ্বকাপ। ঘরের মাঠের টুর্নামেন্টে প্রত্যাশা আকাশচুম্বী। তুলনামূলক দুর্বল দুই দল আয়ারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসকে তো হারাতেই হবে, সঙ্গে আরেকটি বড় শিকার চাই অন্তত। বাংলাদেশ কিন্তু ঠিকই সে প্রত্যাশা পূরণ করে। আইরিশ-ডাচদের পাশাপাশি দৈত্যবধ ইংল্যান্ডকে হারিয়ে। তবু লাল-সবুজের ক্রিকেট সৈনিকদের জন্য ওই বিশ্বকাপ ব্যর্থ হিসেবে গণ্য। গ্রুপ পর্ব পেরোতে পারেনি যে!
২০১৫ বিশ্বকাপ। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের ওই আসরে আশার বেলুন ওড়েনি খুব ওপরে। তবু আফগানিস্তান-স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে তো জিততেই হবে, সঙ্গে যদি আর কোনো বড় দলকে হারানো যায়! কী আশ্চর্য, ঠিকই তা করে বাংলাদেশ। প্রত্যাশিত দুই জয়ের পাশাপাশি জেতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষেও। আর এই বিশ্বকাপ বাংলাদেশের ক্রিকেট খেরোখাতায় চিত্রিত তুমুল সফল হিসেবে। গ্রুপ পর্ব পেরিয়ে এবার কোয়ার্টার ফাইনাল খেলে যে দল! চার বছর আগে-পরের দুই বিশ্বকাপে কী বিপরীত ছবি! গ্রুপ পর্বে ছয় ম্যাচের মধ্যে তিনটিতে জিতেও একবার ব্যর্থ; আরেকবার সফল। কারণ ২০১৫-র জয়গুলোর ব্যাপ্তি কেবল ওই ম্যাচগুলোতে আটকে থাকেনি। বাংলাদেশ কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠায় অর্জনের আকাশটা হয়ে যায় অনেক বড়। বিশ্বকাপ-পরবর্তী সময়েও বাংলাদেশের সাফল্যে প্রভাবকের ভূমিকা রাখে তা।
আজ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জিতলে যা বলে আর কী! এটি তো কেবল এটি ম্যাচ নয়, ফাইনালও বটে। ত্রিদেশীয় সিরিজের ট্রফির হাতছানি। যে ট্রফি চকমকি পাথরের মতো অনুপ্রেরণার মশাল জ্বালিয়ে যাবে বাংলাদেশ ক্রিকেটে। আজকের দ্বৈরথের ক্যানভাস তাই কেবলই একটি ম্যাচ ছাড়িয়ে আরো বড়।
অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা তা মানেন। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গুরুত্বের কথা কাল মনে করিয়ে দেন তিনি, ‘একেকজনের চিন্তাভাবনা একেক রকম। তবে আমি মনে করি, এই টুর্নামেন্ট জিততে পারলে এর প্রভাব ভালো হবে। ড্রেসিংরুমের জুনিয়র ক্রিকেটাররা বুঝবে এমন ম্যাচ জিতলে কেমন লাগে। ওদের মধ্যে এই চাওয়াটা বাড়বে; জয়ের ক্ষুধা তৈরি হবে। ওরা খুব অনুপ্রাণিত হবে। আমাদের সিনিয়রদের জন্যও এটি দারুণ সুযোগ। এ রকম টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা যেকোনো টিমের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ।’ ট্রফি জয়ের জন্য নিজেদের ব্যগ্রতার ঘোষণাও দেন মাশরাফি, ‘এটি সত্য যে ফাইনাল জেতার জন্য আমরা উদ্গ্রীব হয়ে আছি। জিতলে তা হবে প্রথমবারের মতো। তবে এটা হওয়ার আগ পর্যন্ত বেশি চিন্তা করলে চাপ এসে দাঁড়ায়। আর ফাইনাল ম্যাচে তো চাপ থাকেই। এখানে যারা স্নায়ু ঠাণ্ডা রাখতে পারবে, তারাই এগিয়ে থাকবে।’ মিরপুরের ফাইনালে এই স্নায়ুকে বশে রাখার কাজটি সেভাবে কখনো করতে পারেনি বাংলাদেশ। পারেনি বলেই হেরেছে তিন-তিনটি ফাইনালে। এর মধ্যে দুটো তো একেবারে জয়ের মতো অবস্থা থেকে! হয়ে আছে তা ‘দুই-এর দুঃখ’। প্রথমবার শ্রীলঙ্কার কাছে হার দুই উইকেটে; পরেরবার পাকিস্তানের কাছে পরাজয় দুই রানে। নিঃশ্বাস-দূরত্ব থেকে মেরু-দূরত্বে ট্রফির চলে যাওয়ার কষ্টে এখনো মোচড় দিয়ে ওঠে বাঙালির ক্রিকেট-হৃদয়।
২০০৯ সালে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে বাংলাদেশের শুরুটা ভালো হয়নি। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মাত্র ১৫২ রানে অল আউট। ইনিংস শেষে জয়ের আশা তাই দূর দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়ার দশা। কিন্তু দুর্দান্ত বোলিংয়ে রাজসিক প্রত্যাবর্তন স্বাগতিকদের। ছয় রানের মধ্যেই যে লঙ্কানদের ৫ উইকেট তুলে নেয় বাংলাদেশ! অসম্ভব মনে হওয়া জয়টা তখন খুবই সম্ভব। কিন্তু ক্রিকেটদেবতার ক্রূর হাসি আবার স্তব্ধ করে দেয় এই জনপদকে। বিশেষত ১০ নম্বরে নেমে মুত্তিয়া মুরালিধরনের হঠাৎ ব্যাটসম্যান হয়ে ওঠা। ১৬ বলে অপরাজিত ৩৩ রানের ইনিংসে বাংলাদেশের হাতের মুঠো থেকে জয় ছিনিয়ে নেন এই চ্যাম্পিয়ন অফ স্পিনার।
২০১২ এশিয়া কাপ ফাইনাল আরেক বিষাদকাব্য। এবারের প্রতিপক্ষ পাকিস্তান। তাদের ইনিংস থেমে যায় ২৩৬ রানে। জবাবে বাংলাদেশের ক্রিকেট ক্যারাভান হুইসেল বাজিয়ে ছুটছিল জয়ের স্টেশনের দিকে। পৌঁছে যায় ৩ উইকেটে ১৭০ রানে। তবু শেষ পর্যন্ত কক্ষচ্যুত হয়ে পড়ে ওই ক্যারাভান। হেরে যায় মাত্র ২ রানে। ফাইনাল শেষে সাকিব আল হাসানের জলভেজা পাথুরে মুখের ছবি হয়ে যায় বাঙালির মনের প্রতিচ্ছবি।
বাংলার ক্রিকেট তীর্থে আরেকটি ফাইনাল খেলে স্বাগতিকরা। ২০১৬-র সেই এশিয়া কাপ ফাইনালের সঙ্গেও রয়েছে দুই-এর যোগ। এবার ভারতের মাত্র ২ উইকেট তুলে নিতে পারে বাংলাদেশ; হেরে যায় ৮ উইকেটে। প্রথম দুই ফাইনালের লড়াইয়ের ঝাঁজ সেখানে অনুপস্থিত, নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের প্রতিচ্ছবি তাতে।
এই তিনটি ফাইনালই খেলেছেন মাশরাফি। স্মৃতিগুলো তাঁর ভুলে যাওয়ার কথা না। তবু কাল হাসতে হাসতে করেন অমন দাবি, ‘এসব আসলে আমার মাথায় ছিল না। মনে না করালেই পারতেন।’ এরপর ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তি রোধে নিজেদের করণীয়টা বলেছেন মাশরাফি, ‘আমি হয়তো তিনটি ফাইনালে ছিলাম। মুশফিক ছিল, সাকিব ছিল, তামিমও ছিল হয়তো বা। তো এটা আমাদের জন্য নতুন আরেকটা সুযোগ। কালকে সম্পূর্ণ নতুন একটা ম্যাচ। আগের ম্যাচগুলো নিয়ে ভাবার দরকার মনে করছি না। প্রথম তিন ম্যাচের মতো ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে কাল খেলতে নামার আশা করছি।’
তাতে যদি শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের ফাইনালে বাংলাদেশের দুঃখ ঘোচে! আর সেটি হলে হয়তো বাংলাদেশ ক্রিকেটে এই একটি ট্রফির প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। ঠিক হয়তো ওই ২০১৫ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার মতো!

0 comments: