মস্তিষ্কের যত্ন: যে অভ্যাসগুলো অজান্তেই আপনার মস্তিষ্কের ক্ষতি করছে


আমাদের অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দু হলো মস্তিষ্ক। প্রায় ১০০ বিলিয়ন কোষের সমন্বয়ে গঠিত এই বিস্ময়কর অঙ্গটি আমাদের প্রতিটি চিন্তা, অনুভূতি এবং কর্মকে নিয়ন্ত্রণ করে। মস্তিষ্ক যত বেশি ব্যবহৃত হয়, এটি তত বেশি শক্তিশালী ও কার্যকর হয়ে ওঠে। তবে বয়স ৪০ পেরোলে এর কার্যক্ষমতা স্বাভাবিকভাবেই কমতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে এটি সংকুচিত হতে থাকে। ৬০ বছর বয়সের পর এই প্রক্রিয়া আরও দ্রুত হয়, যার ফলে স্মৃতিশক্তি লোপ পায় এবং ডিমেনশিয়া বা আলঝেইমারের মতো মারাত্মক রোগের ঝুঁকি বাড়ে।

দৈনন্দিন জীবনে আমরা জেনে বা না জেনে এমন কিছু কাজ করি, যা আমাদের মস্তিষ্কের জন্য নীরব ঘাতক হিসেবে কাজ করে। বিজনেস গ্রোথ মেন্টরদের মতে, এই অভ্যাসগুলো আমাদের মস্তিষ্কের সুদূরপ্রসারী ক্ষতি করে। আসুন, জেনে নেওয়া যাক সেই মারাত্মক অভ্যাসগুলো সম্পর্কে।

১. আলোর স্বল্পতা ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি

প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সময় অন্ধকারে বা কম আলোতে থাকা আমাদের মস্তিষ্কের ওপর গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটি বিষণ্ণতার মতো মানসিক সমস্যা তৈরি করতে পারে, যা মস্তিষ্কের সার্বিক কার্যকারিতা মন্থর করে দেয়। প্রাকৃতিক আলো আমাদের মস্তিষ্কের জন্য অপরিহার্য। এটি মনকে সতেজ রাখে এবং মস্তিষ্ককে সঠিকভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। শীতপ্রধান দেশগুলোতে আত্মহত্যার হার বেশি হওয়ার পেছনেও আলোর অভাবজনিত বিষণ্ণতাকে একটি বড় কারণ হিসেবে দেখা হয়।

২. নেতিবাচক খবরের করাল গ্রাস

অতিরিক্ত নেতিবাচক খবর দেখা, পড়া বা শোনার অভ্যাস ত্যাগ করা উচিত। এই ধরনের খবর আমাদের মনে গভীর উদ্বেগ ও ভয় তৈরি করে। এই মানসিক চাপ ধীরে ধীরে মস্তিষ্ক এবং শরীরের ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে, যা মস্তিষ্কের কোষগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

৩. উচ্চ শব্দের বিপদ: শ্রবণশক্তি ও মস্তিষ্কের ক্ষয়

উচ্চ ভলিউমে গান শোনা বা কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে দীর্ঘক্ষণ থাকা মস্তিষ্কের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। টানা ৩০ মিনিট উচ্চ শব্দে থাকলে শ্রবণশক্তি স্থায়ীভাবে লোপ পেতে পারে। বিশেষ করে বয়স্কদের ক্ষেত্রে শ্রবণশক্তি হ্রাসের সঙ্গে স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া এবং মস্তিষ্কের টিস্যু নষ্ট হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। যারা হেডফোনে উচ্চ শব্দে গান শোনেন, তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা বোঝার জন্য মস্তিষ্ককে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়, যা মস্তিষ্কের ওপর অপ্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টি করে।

৪. সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: একাকিত্বের নীরব আঘাত

মানুষ স্বভাবগতভাবেই সামাজিক জীব। কাছের মানুষের সঙ্গে সুস্থ ও সুন্দর সম্পর্ক বজায় রাখা আমাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাজার হাজার বন্ধু থাকার চেয়ে বাস্তবে দু-একজন ভালো বন্ধু থাকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যারা পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন, তারা মানসিকভাবে বেশি হাসিখুশি, কর্মঠ এবং সুস্থ থাকেন। তাদের মধ্যে আলঝেইমারের ঝুঁকিও তুলনামূলকভাবে কম।

৫. ডিজিটাল আসক্তি ও স্ক্রিন টাইমের প্রভাব

টেলিভিশন, ল্যাপটপ বা মোবাইলের স্ক্রিনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকা মস্তিষ্কের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম আমাদের সৃজনশীলতা নষ্ট করে এবং মস্তিষ্কের গঠনগত ক্ষতি করতে পারে। এর আরেকটি বড় নেতিবাচক দিক হলো, স্ক্রিনে বেশি সময় কাটানোর ফলে আমরা কথা কম বলি। মানুষের সঙ্গে কথা বলা ও ভাবের আদান-প্রদান মস্তিষ্কের জন্য একটি জরুরি ব্যায়াম। এই অনুশীলন কমে গেলে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাও কমে যায়।

৬. অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও মস্তিষ্কের সংকোচন

অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার এবং জাঙ্ক ফুড (যেমন: বার্গার, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, কোমল পানীয়) আমাদের শরীর ও মস্তিষ্ক উভয়ের জন্যই বিষের মতো। এই ধরনের খাবার মস্তিষ্কের শেখার ক্ষমতা, স্মৃতিশক্তি এবং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য দায়ী অংশগুলোকে সংকুচিত করে ফেলে। অন্যদিকে, সবুজ শাকসবজি, ফলমূল, বাদাম এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার মস্তিষ্কের কোষকে সজীব রাখে এবং এর ক্ষয় রোধ করে।

৭. শরীরচর্চার অভাব ও ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি

নিয়মিত শরীরচর্চা না করলে কেবল শারীরিক রোগ নয়, মস্তিষ্কের রোগ হওয়ার আশঙ্কাও বহুগুণে বেড়ে যায়। শরীরচর্চার অভাবে ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগ এবং উচ্চ রক্তচাপের মতো সমস্যা দেখা দেয়, যার প্রতিটিই আলঝেইমার রোগের ঝুঁকির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। নিয়মিত ব্যায়াম মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন বাড়ায় এবং একে সচল ও সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।

৮. অপর্যাপ্ত ঘুম: মস্তিষ্কের জন্য বিশ্রামহীনতা

মস্তিষ্কের восстановления এবং স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য ঘুম অপরিহার্য। দৈনিক ছয় ঘণ্টার কম ঘুম মস্তিষ্কের ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করে এবং এর কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য দৈনিক ৭-৮ ঘণ্টা গভীর ঘুম নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।

আমাদের মস্তিষ্কই আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ। তাই দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট এই ভুলগুলো এড়িয়ে চলে একটি সুস্থ ও সুন্দর জীবনযাপনের মাধ্যমে মস্তিষ্ককে সচল ও ধারালো রাখা আমাদের সকলের দায়িত্ব।

0 comments: