সম্প্রতি দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের খালাস পাওয়ার ঘটনাটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে পুরোনো বিতর্ককে নতুন করে উসকে দিয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠিত ন্যারেটিভকে এই রায় এমনভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে যে, এর পেছনের রাজনীতি ও বাস্তবতা নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই। যে আলাপ বছরের পর বছর ধরে চলেছে—"বাবর দশ ট্রাক অস্ত্র নিয়ে আসছিলেন"—তা যদি মিথ্যাই হয়, তবে আসল সত্যটা কী?
যুক্তির কাছে কি আবেগ পরাজিত?
প্রথমেই যে প্রশ্নটি সামনে আসে, তা হলো—লুৎফুজ্জামান বাবর কেন নিজের সরকারের সময়ে অবৈধভাবে অস্ত্র আনবেন? তিনি তখন রাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, দেশের সকল আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থা তার অধীনে। যার নিয়ন্ত্রণে পুরো দেশের বৈধ অস্ত্রের ভান্ডার, তার কেন লুকিয়ে দশ ট্রাক অস্ত্র আনার প্রয়োজন পড়বে? এই সাধারণ যুক্তি বরাবরই আওয়ামী লীগের তৈরি করা রাজনৈতিক ন্যারেটিভের আড়ালে চাপা পড়ে গেছে।
সবচেয়ে বড় পরিহাস হলো, যে জোট সরকারের আমলে এই বিপুল পরিমাণ অস্ত্রের চালান আটক করা হয়েছিল, সেই সরকারকেই পরবর্তীকালে এই মামলার আসামি বানানো হয়। যারা অস্ত্র ধরলো, তারাই হয়ে গেল অপরাধী—রাজনীতির কি विचित्र খেলা!
অস্ত্রের আসল গন্তব্য কোথায় ছিল?
সত্যিকার অর্থে, এই অস্ত্রের চালান বাংলাদেশের জন্য ছিল না। এটি ছিল ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফা (ULFA)-এর জন্য। বাংলাদেশকে নিছক একটি রুট হিসেবে ব্যবহার করে ভারতের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত এই গোষ্ঠীর হাতে অস্ত্রগুলো পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল।
তৎকালীন সরকারের একটি অংশ হয়তো চেয়েছিল, চালানটি নিরাপদে উলফার হাতে পৌঁছাক। geopolitics বা ভূ-রাজনীতির বিবেচনায় অনেকেই মনে করেন, ভারতের আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে উলফার মতো শক্তিকে সহায়তা করা ছিল একটি যৌক্তিক কৌশল। যেকোনো স্বাধীন দেশেরই উচিত প্রতিবেশীর আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। তবে, প্রশাসনের অন্য কোনো অংশের হস্তক্ষেপে চালানটি ধরা পড়ে যায়, যা জোট সরকারের জন্যই একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করে।
পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সরকার এই ঘটনাকে পুঁজি করে একটি রাজনৈতিক ন্যারেটিভ তৈরি করে, যেখানে বিএনপি-জামায়াত জোটকে সরাসরি "জঙ্গিবাদী" ও "রাষ্ট্রদ্রোহী" হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়। দুঃখজনকভাবে, অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বক্তা আজও সেই একই ন্যারেটিভ অনুসরণ করে চলেছেন, যা সত্যকে আড়াল করে কেবল রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা মাত্র।
বাবর: একটি নাম, একটি প্রতীক
লুৎফুজ্জামান বাবর আজ কেবল একজন ব্যক্তি নন, তিনি একটি প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। তিনি সেই শক্তির প্রতীক, যা আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চেয়েছিল। তার বিরুদ্ধে এত বছরের রাজনৈতিক প্রচারণা প্রমাণ করে যে, তিনি দিল্লির জন্য একটি বড় আতঙ্কের নাম ছিলেন। বাবর প্রমাণ করেছেন, দেশপ্রেম এবং জাতীয় স্বার্থকে সবার উপরে স্থান দিলে যেকোনো আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো সম্ভব।
বাবর হওয়া সহজ নয়। এর জন্য যে সাহস, দূরদর্শিতা এবং দেশপ্রেম প্রয়োজন, তা সবার থাকে না। তার মুক্তি কেবল একজন ব্যক্তির মুক্তি নয়, এটি একটি চেপে রাখা সত্যের মুক্তি।
0 comments: