শিক্ষকতা একসময় ছিল সম্মান ও ত্যাগের প্রতীক। কিন্তু আজ সেই পেশার একটি বড় অংশ পরিণত হয়েছে ব্যক্তিস্বার্থের উপার্জনের কেন্দ্রে। বেতন, প্রাইভেট টিউশনি, স্কুল সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত আর্থিক সুবিধা—এসব মিলিয়েও যেন তাদের পেট ভরছে না। অনেকে স্কুলের বাইরে জমি চাষ, পশুপালন বা ছোটখাটো ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন। অথচ কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন ও শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ গঠনের প্রশ্নে অনীহা প্রকট।
আরও দুঃখজনক হচ্ছে, এদের অনেকেই প্রকৃত যোগ্যতার ভিত্তিতে নয়, বরং নামমাত্র সনদ ও সেকেন্ড কিংবা থার্ড ডিভিশনের ফলাফলের পর কয়েক লক্ষ টাকার উৎকোচ দিয়ে চাকরি অর্জন করেছেন। এই অবৈধ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যারা শিক্ষক হয়েছেন, তাদের কাছ থেকে পেশাদারিত্ব বা শিক্ষার্থীর প্রতি দায়িত্ববোধের প্রত্যাশা করাই যেন বিলাসিতা।
নওগাঁ জেলার বদলগাছি উপজেলার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো—বদলগাছি সরকারি মডেল পাইলট হাই স্কুল ও লাবণ্যপ্রভা কমিউনিটি গার্লস হাই স্কুল এবং পাহাড়পুর আদিবাসী উচ্চ বিদ্যালয়—এ সম্প্রতি শিক্ষকদের একাংশ কর্মবিরতি ঘোষণা করে শ্রেণিকক্ষ বন্ধ রেখেছেন।
শিক্ষার্থীরা ক্লাসে উপস্থিত হলেও শিক্ষকরা পড়াতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। ফলে পুরো এলাকা জুড়ে ক্ষোভ ও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে।
অভিভাবকদের অনেকেই অভিযোগ করেছেন, এই কর্মসূচির পেছনে শিক্ষকদের প্রকৃত দাবি নয়, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রাধান্য পাচ্ছে। বদলগাছির উভয় বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক, এমনকি প্রধান শিক্ষকসহ সহযোগী শিক্ষকরা আওয়ামীপন্থী সংগঠনের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। স্থানীয়দের ধারণা, শিক্ষা ব্যবস্থার মান নষ্ট করে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্যই এই কর্মবিরতির আড়ালে এমন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে।
একজন অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমার ছেলে ক্লাস নাইনে পড়ে। আজ সকালে স্কুলে গিয়ে দেখে গেট খোলা, কিন্তু ক্লাসের দরজা বন্ধ। শিক্ষকরা অফিসে বসে আছেন, কেউ পড়াতে যাচ্ছেন না। ওরা নাকি আন্দোলন করছে। কিন্তু দোষটা কে ভোগ করছে? আমাদের বাচ্চারা।”
শিক্ষার্থীদের মধ্যেও ক্ষোভ স্পষ্ট। ক্লাস এইটের ছাত্রী রিতু আক্তার জানায়, “আমরা সকালে এসে দেখি ক্লাস বন্ধ। ম্যাডাম বললেন, আন্দোলন চলছে, পড়া হবে না। এখন তো পরীক্ষাও কাছে, কী করব বুঝতে পারছি না।”
ক্লাস টেনের শিক্ষার্থী সজল হোসেন বলেন, “এখন আমাদের এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে। এই সময়ে ক্লাস বন্ধ থাকলে তো আমরা পিছিয়ে যাব। শিক্ষকরা যদি নিজেরাই ক্লাস না নেন, তাহলে পড়ব কার কাছে?”
একই ধরনের প্রতিক্রিয়া এসেছে ক্লাস সেভেনের ছাত্র আরিফুলের কাছ থেকেও। তার ভাষায়, “আমরা তো পড়তে এসেছি। স্যাররাই ক্লাসে ঢুকতে দিচ্ছেন না। এটা তো অন্যায়।”
দাবি আদায় করা নাগরিক অধিকার। কিন্তু দাবি জানানোরও শালীন উপায় রয়েছে। যে শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন জ্ঞান অর্জনের জন্য বিদ্যালয়ে আসে, তাদের ক্লাসে ঢুকতে না দেয়া কোনোভাবেই ন্যায্য আন্দোলনের অংশ হতে পারে না। এর মাধ্যমে শিক্ষকদের দাবি নয়, বরং শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তিই দুর্বল হচ্ছে।
বর্তমানে দেশে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব পালন করছে, যার মূল কাজ নির্বাচনের প্রস্তুতি ও কিছু প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়ন। এই সরকারের কাছে শিক্ষকরা যখন নানা দাবি জানাচ্ছেন, তা কার্যত অযৌক্তিক, কারণ নীতি নির্ধারণ বা আর্থিক বরাদ্দের ক্ষমতা এখন সীমিত। তাদের প্রকৃত দাবি জানানো উচিত নির্বাচিত সরকারের কাছে, যারা জনগণের ভোটে ক্ষমতায় এসে দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবে।
কিন্তু আন্দোলন এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সরকারি ঘোষণা ছাড়াই বহু স্কুল কার্যত বন্ধ। শিক্ষার্থীরা ক্লাস করতে এলেও তাদের ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ যেন শিক্ষা নয়, বরং বিভ্রান্তির পাঠচক্র চলছে।
এই পরিস্থিতি শুধু শিক্ষা প্রশাসনের নয়, গোটা জাতির জন্যই একটি সতর্ক সংকেত। শিক্ষক সমাজ যদি নিজেদের আত্মসমালোচনা না করে, তবে আগামী প্রজন্মের নৈতিকতা, জ্ঞান ও দায়িত্ববোধ—সবই প্রশ্নের মুখে পড়বে।
জ্ঞানবিরোধী আন্দোলন কখনও শিক্ষক সমাজের সম্মান বাড়ায় না; বরং ভবিষ্যতের চোখে তাদের অযোগ্য করে তোলে।
আওয়ামী ফ্যাসিবাদের অন্যতম দোসর বদলগাছি লাবণ্য প্রভা কমিউনিটি গার্লস হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক।
0 comments: